বেনজীন খান: আমাদের ভূত-ভবিষ্যত, অতঃপর কবে মানুষ হব


স্বপ্নসারথি ডেস্কঃ প্রকাশের সময় : জুন ৮, ২০২৩, ১০:০৫ PM / ১৭৮
বেনজীন খান: আমাদের ভূত-ভবিষ্যত, অতঃপর কবে মানুষ হব
ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশের শাসন নিয়ে লিখতে গিয়ে “উপনিবেশিকতা প্রসঙ্গে” গ্রন্থে কার্ল মার্কস এক জায়গায় বলছেন– ‘ভারতের কোনো ইতিহাস নেই, অন্তত জানা কোনো লিখিত ইতিহাস; যেটুকু আছে তা পরপর বিজিত হওয়ার ইতিহাস’!
তিনি আরো বলছেন– ‘এখানকার মানুষেরা গাছের মতো, গতরে বাড়ে কিন্তু জায়গা থেকে নড়ে না’!
হয়তো তাঁর এই বক্তব্য নিয়ে আমাদের সমালোচনা আছে, যদিও তা খুবই কম, কিন্তু তর্ক আছে ঢের। কেননা আমরা তর্কপ্রিয়, এতেই অভ্যস্ত, সম আলোচনায় নয়!
কিন্তু বাস্তবতা হলো ভারতের ইতিহাস বারবার বিদেশি আক্রমণে পরাস্ত হওয়ার ইতিহাস। পারস্য-গ্রীক-আরব-ডাচ-ব্রিটিশ-ফরাসি যে কেউ কত সহজেই না দখল করেছে আমাদের দেশ! শুধু দখলই নয়– যুগের পর যুগ তারা শাসন করেছে, লুট করেছে, শোষণ করেছে, হত্যা ও ধর্ষণও করেছে। তারা আমাদের মানুষও দখল করেছে। সেই দখলি মানুষের হাতে চাবুক ধরিয়ে দিয়ে আপন সহোদরের পিঠের চামড়া তুলিয়েছে।
কারণ, গাছের মতো গতরে বাড়া চিন্তায় স্থবির নির্বোধ আধা মানুষের দ্বারা আর কি বা হওয়ার কথা? আর পরচর্চা নিন্দা গীবত ও ষড়যন্ত্রে যে জাতি চরম উৎসাহে চব্বিশ ঘন্টা লিপ্ত থাকে। যাদের ভাবনা নেই। জ্ঞানের ক্ষুধা নেই। চিন্তার কোনো বিকাশ নেই, স্থবির। যারা জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ এবং তা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অংশ নেওয়া থেকে দূরে থাকে; সে জাতির ভাগ্যে বারবার পরাজয়ই ঘটবে, এটা ইতিহাসের রায়।
আমরা অযথা তর্কপ্রিয়, এটা আমাদের সম্পর্কে ওরিয়েন্টালিস্টদের অভিযোগ। তাদের আরো অভিযোগ আছে– আমরা গড় কথা বলি, অলস, নিন্দুক, আত্মকেন্দ্রিক, সুবিধাবাদী, পরশ্রীকাতর ও হীনমন্যতায় ভুগী; ছোটবড় নানামাত্রার কমপ্লেক্স আমরা সযতনে পূষি। ঠুনকো স্বার্থে সবকিছু বিকিয়ে দিতে পারি। আমরা যোগ্য ব্যক্তির মর্যাদা দিতে জানিনা। লড়াই সংগ্রাম বিমুখ। আমরা মূর্খ চোর ডাকাত সন্ত্রাসীর সম্মান করতে ভীষণ পছন্দ করি। আমরা তুকতাক, মারণ উচাটন বশীকরণ ইত্যাদির ক্রিয়াকলাপে বিশ্বাসী ।
ওরিয়েন্টালিস্টদের এই গড় অভিমতের বিরুদ্ধেও হয়তোবা আমাদের অনেক তর্ক আছে সত্য, কিন্তু তাদের পর্যবেক্ষণ কি সর্বৈব উপেক্ষা করা যায়?
ব্রিটিশদের একটা কোম্পানি (ইস্ট ইন্ডিয়া) মাত্র কয়েক’শ সৈন্য নিয়ে যত সহজে প্রাচ্যদেশ বিশেষত বড়বাংলা দখল করেছিলো এমন নজির কি পৃথিবীতে ভুরি ভুরি আছে? এবং এটা কি কখনই সম্ভব হতো এই বাংলার গুটিকয় বেইমান বিশ্বাসঘাতকদের ঠুনকো স্বার্থ হাসিলের আকাঙ্ক্ষা ছাড়া? আর বাঘ-সিংহ-হায়েনাদের শিকারের সময় যে দৃশ্য বনের অপরাপর জীবজন্তুরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, তেমনি জন্তু-জানোয়ারের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিল মাতৃভূমি দখলের দৃশ্য, এদেশের দু’পেয়ে আধা মানুষের পাল। আফসোস!
এদেশের মানুষেরা সংঘশক্তিতে অবিশ্বাসী। সচেতন প্রয়াস গড়তে নাখোস। ব্যক্তিস্বতন্ত্রতার নামে বিচ্ছিন্নতার মনোরোগে ভোগে। এরা সাম্রাজ্য নয় ‘উপজাতি’ জীবন পছন্দ করে। গড়ার চেয়ে ভাঙতে ভালোবাসে। এরা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে ব্যর্থ হয়ে প্রতিষ্ঠান বিরোধী হয়। অজুহাত এদের বাহন আর অভিযোগ দাওয়াই। সৃষ্টি নয় নকলই এদের ব্যর্থ প্রয়াস। এদের নিজস্ব কোন আইডিয়া নেই, স্বপ্ন নেই, মূলত এরা চিন্তায় যাযাবর।
এখানে বুকিস মুখস্ত কিছু পাকা পাকা কথা বললেই বুদ্ধিজীবী হওয়া যায়। এখানকার বুদ্ধিজীবীরা বুদ্ধি বেঁচে খায়। সরকার ও তস্করের পদলেহি হয়। রাষ্ট্র ও নাগরিককে গৌণ করে দেখে। সমাজ রাষ্ট্র নাগরিক কখনোই তাদের বিচার্য বিষয় নয়। তারা কখনই সমাজ ভাবনায় ডুব দেয় না। কারণ তা ঝুঁকিপূর্ণ। মূলত এই সকল বুদ্ধিজীবীরা প্রজাতন্ত্রের চাকরদের চাকর। তারা গাছের উপর-নিচের সবই খেতে চায়। এরা তাই বড় জোর বুদ্ধি বিক্রেতা, জ্ঞানী নন। বুদ্ধিজীবী এবং জ্ঞানীর মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে। আমাদের এই জনপদে এখন ‘বুদ্ধিজীবী’ এক ধাঁন্দাবাজ সম্প্রদায়ের নাম। আর মূর্খ দু’পেয়ে জীবজন্তুরা তাদের পিছুপিছু ঘুরঘুর করে উচ্ছিষ্ট জ্ঞান লাভের করুন আকাঙ্ক্ষায়।
সম্প্রতি এদেশে একটা ফ্যাশন খুবই চোখে পড়ে। তারা যত্রতত্র টক শো বা আলোচনায় চলতি সময়ের আগে পরের কিছু দার্শনিক ভাষাবিজ্ঞানী রাজনীতিক অ্যাক্টিভিস্টের নাম কপচাতে থাকে যেমন: আন্তোনিও গ্রামশি, ফ্রেড্রিক উইলহেল্ম নিৎশে, মিসাল ফুকো, জাঁ দেরিদাঁ, জাক লাকঁ, একবাল আহমাদ, এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ, আভ্রাম নোম চমস্কি, তালাল আসাদ, অরুন্ধতী রায়, মেধা পাটেকার প্রমুখজনের। যদিও তাদের ঝুঁকিপূর্ণ কর্ম ও আত্মত্যাগের সাথে এদের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু এসব নাম তারা কপচায় এই জন্য যে, আধামানুষগুলো ভাবে, ওরে বাবা! আলোচক মহাশয় কত বড় প্রাণী।
আসলে এরা পন্ডিত সাজতে পছন্দ করে, কারণ পাণ্ডিত্য এখন পণ্য, কিন্তু দায়দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে। এরা সত্য কাজে সরকার ও তসকরের বিরাগভাজন হতে না রাজি, কিন্তু দুর্ণীতি করে জেলে যেতে ভয় পায় না।
এ জাতি সামনে নয়, পিছনে বলতে পছন্দ করে। নিজে প্রতিবাদ প্রতিরোধে অংশ নেয় না কিন্তু প্রতিবাদীর ভুল ধরতে সদা প্রস্তুত। এরা নার্সিসিজমে ভোগে, স্বীয় প্রতিমূর্তির প্রেমে ডুবে মরে। এরা পশুর মত স্বতঃস্ফূর্ত, মানুষের মতো সচেতন নয়। এরা বড়জোর অন্ধকার যুগের উপযোগী, সে কারণে জঙ্গলের আইন মেনে নেয়। এরা একদিন গত হলেই সব ভুলে যায়। খুব সহজেই এরা অবিচার অপমান মেনে নেয়।
আমরা পশুর মত ভোগ করতে জানি কিন্তু মানুষের মত উপভোগ করতে পারি না। সে কারণে মানবজাতির যেকোন মহান অর্জন আমাদের হাতে এসে পড়লেই তা অপব্যাখ্যায় মল-মূত্র হয়ে যায়। ধর্ম রাজনীতি সাহিত্য সবকিছু আজ আমাদের হাতে পড়ে গু-মুত হয়ে গেছে। ইসলাম সমাজতন্ত্র গণতন্ত্র আধুনিকতা সবকিছুকে আমরা আমাদের গরুর পায়ের মলনে পল-আবর্জনা বানিয়ে ফেলেছি।
এখানে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন এবং রাজপথের লড়াই সবসময় দ্বৈতভাব-এ চলেছে। এখানে আসমানী জীবনবিধানগুলোকে দৈনন্দিন রাজনৈতিক জীবন থেকে আলাদা করা হয়েছে। এখানে সমাজ এবং রাষ্ট্রকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। এখানে শাসক এবং তার শ্রেণিকে জনগণের প্রভু বানানো হয়েছে। আর এ সবই সম্ভব হয়েছে এখানকার মানুষের খাসলোতের কারণে। আধামানুষ রয়ে যাওয়ার কারণে। কবে আমরা পূর্ণ মানুষ হব?