রাজনীতি ও বাংলাদেশ: আলমগীর মতিন চৌধুরী


স্বপ্নসারথি ডেস্কঃ প্রকাশের সময় : মার্চ ১৮, ২০২৩, ৮:২০ PM / ৬৪২৫
রাজনীতি ও বাংলাদেশ: আলমগীর মতিন চৌধুরী

রাজনীতির শাসন-শোষণ, প্রকৃতির ঝড়-ঝাপটার সাথে নিত্য যুদ্ধক্ষেত্রের যোদ্ধা আমাদের গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষগুলো কেমন আছে? রাজনীতির খেলার মাঠে দেশের বৃহৎ গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বরাবর’ই দর্শক সারিতে থাকে। জন্ম থেকে নানা প্রতিকূলতার সাথে বেড়ে উঠা সংগ্রামী এ মানুষগুলোর আকাশ ছোঁয়া হৃদয়। চাওয়া, পাওয়া, হারানোর বেদনা গ্রামের মানুষের কাছে একেবারে তুচ্ছ। পল্লীর কঠোর পরিশ্রমী নর-নারী উদার মনে বিলিয়ে স্বর্গীয় প্রশান্তি উপভোগ করে। ঠিক সভ্যতার গোড়া পত্তনের সময়ে এরা যেমন ছিলো আজও তেমন আছে। গ্রামের মানুষেরা এই প্রাচীন সমাজের ধারক বাহক। বাকি সব সেবা দাস, চাক-বাকর, খোলস পাল্টানো সাহেব, নব্য বাবু।

সম্মানের সাথে বলতে গেলে গ্রামের মানুষ আমাদের অভিভাবক, দেশের প্রথম শ্রেণির সুনাগরিক। স্বাধীন বাংলার সংবিধানে মেহনতি কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর, সাধারণ মানুষকে প্রজা বলা হয়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণই সকল ক্ষমতার দাবিদার, তাদের ভোটে গড়ে উঠে সরকার ও রাজনীতি। সেই অর্থে বাংলাদেশের সংবিধানে প্রজা শব্দটি একেবারে বেমানান। প্রজা শব্দটি এখনি উঠিয়ে দিয়ে নাগরিক কিংবা জনগণ শব্দগুলো ব্যবহারের প্রয়োজনীতা রয়েছে বলে মনে করি। দেশে রাজা শাসিত সরকার নেই, নেই রাজতন্ত্র কিন্তু সেখানে কেনো রাজনীতি থাকবে? সরকার-প্রশাসন জনগণ কর্তৃক নিযুক্ত সাধারণ নাগরিকের সেবক, সেবাদাস। সেহেতু রাজনীতির পরিবর্তে জননীতি চালু করার সময় এসেছে। রাজনীতি এখন নানা পেশার মানুষের ভোগ বিলাসের উপজীব্য হয়ে উঠেছে। কল্যাণকর আদর্শের রাজনীতি এখন আর চোখে পড়ে না। দেশজুড়ে চলছে অপরাজনীতির হলিখেলা। অপরাজনীতির অপঘাতে জ্বলছে সারাবিশ্ব। ভালো নেই আমরা, আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় অবস্থা। সবকিছু রাজনৈতিক ক্ষমতালিপ্সুদের নিয়ন্ত্রণে থাকা দখলী মাঠ। লোভ, হিংসা-প্রতিহিংসা, অহংকারসহ নানা কারণে বিশে^র ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে চলছে প্রতিযোগিতা। অসম প্রতিযোগিতায় চলছে অর্থনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি, লাভ-লোকসানের হিসেব-নিকেশ। গুটিকয়েক ব্যক্তির মতমর্জির ওপর চলছে বিশ্ব। আমাদের ভাষা ট্রেজেডিতে মানুষের ইচ্ছের বিরুদ্ধে অপরসীম হতাশা অসহায়ত্বতার কথা কখনো ভূলবার নয়। তারা মনে করলে যেকোনো সময়ে ঠুনকো অভিযোগ চাপিয়ে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে ভয়াবহ আক্রমণে প্রাণ হারায় অসংখ্য মানুষ। হারিয়ে যায় জীববৈচিত্রের ভারসাম্য। ক্ষতিগ্রস্ত হয় অনেক দেশ, জাতি। লন্ডভন্ড হয়ে যায় জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকি শহর। এমনিভাবে ৭১ সালে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয় এক অসহনীয় যুদ্ধ, নিরীহ বাঙালির ওপর আধুনিক অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তান। শহীদ হন ৩০ লাখ মানুষ এবং সম্ভ্রমহানি হয় দুই লাখ মা-বোনের। ২০০৩ সালে বিশে^র বেশিরভাগ দেশ এমনকি ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া ও চীনের আবেদন অগ্রাহ্য করে এবং জাতিসঙ্ঘকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াকে সাথে নিয়ে এক অযৌক্তিক যুদ্ধ শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আক্রমণ করে নিরীহ ইরাকিদের ওপর। এ যুদ্ধে নারী ও শিশুসহ কয়েক লাখ মানুষ নিহত হয়। লিবিয়ার একই পরিনতি, সেখানকার পরিস্থিতি মোটেও ভালো না। ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিমর্মতায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সিরিয়া, লিবিয়া, ফিলিস্তিন প্রভৃতি দেশে যুদ্ধ এখনো চলমান। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে জম্মু ও কাশ্মীর সীমান্তে প্রতিনিয়ত গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং মানুষের জ্ঞানবিজ্ঞান ও গবেষণালব্ধ মানব বিধ্বংসী মরণাস্ত্রের কাছে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে মানবতা। মানুষ মানুষের জন্য না হয়ে মানুষই হয়েছে মানুষের শত্রু। এমন মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে হবে আমাদের। এজন্য বিশ^ বিবেককে নাড়া দিতে হবে। বিশ^বিবেক জাগ্রত না হলে মানুষ হত্যার এ লীলা কখনো বন্ধ হবে না। যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। চাই সুন্দর একটি পৃথিবী। সমগ্র পৃথিবীর মানব সভ্যতার পথ চলা হবে এক ও অভিন্ন মতে। এক ছাদের নীচে। প্রত্যাশা, বিশ্ব হবে একান্নবর্তী বিশাল এক পরিবার। বাংলার ইতিহাসের বরপুত্র খোকাবাবুর জন্মদিন আজ, গতকালও আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছি, ঢাকার কয়েককটি গণমাধমে তা ফলাও করে ছাপিয়েছে। আমি যখন লিখতে বসেছি তখন গহীন অন্তরে বৈশ্বিক নানা সমস্যা-যন্ত্রণা উকি দিচ্ছিলো। প্রাকৃতিক দুর্যোগ করোনা মহামারীর প্রভাব এখনো কাটেনি। এরই মধ্যে রাশিয়ার অব্যাহত বোমার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে ইউক্রেন। যুদ্ধ ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ থেমে গেছে কিন্তু ভয়াবহতা আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি পৃথিবীর বহু মানুষ। ছোটবেলায় দেখেছি পরাধীন এ অঞ্চলের মানুষের কী অভাব-কষ্ট। কৃষি নির্ভরশীল মানুষের কাজ বলতে ছিল কৃষি। বৃহৎ জনগোষ্ঠির সামান্য একটি অংশ তাঁঁত চালাতো। তাঁতিদের সুতা নেই, রং নেই। কাপড়ের বাজারে ঠিকমতো দর পেতো না। অভাবের তাড়নায় অসংখ্য মানুষের পরনে কাপড় নেই, শীতে গায়ে চাদর নেই। পায়ে জুতা নেই। পাকাবাড়ির কথা চিন্তা করা যেত না। টিনের ঘরবাড়ি খুবই কম। গ্রাম জুড়ে খড় কিংবা হোগলা পাতার ছাউনি, মাটির ঘর। ডাক্তার-ঔষধ পাওয়া যেত না। চিকিৎসার সুযোগ নেই। দু’একজন হাতুড়ে ডাক্তার, কবিরাজই ছিল একমাত্র ভরসা। চোখ মেলে তাকালে চারদিকে অভাবী মানুষের মুখ ছাড়া অন্যকিছুর দেখা মিলতো না। অপরিকল্পিত কৃষিতে উৎপাদিত ফসল দিয়ে কয়েক মাস চললেও ফাল্গুন-চৈত্র এলেই বাংলাদেশ ভূখন্ডে ‘মঙ্গা’ দেখা দিতো। অনাহার ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। অভাবের তাড়নায় আষাঢ়-শ্রাবণ আর পার হতো না। এইতো কয়েক বছর হলো মাত্র বাংলাদেশ মঙ্গাকে বিদায় জানিয়েছে। বর্তমানে দেশ প্রযুক্তিগত কৃষিতে কেবলমাত্র স্বনির্ভরই নয়, একটি কৃষি রপ্তানিকারক দেশেও রূপান্তরিত হয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে তাঁত আর পাটশিল্প ছাড়া কোনো শিল্প ছিল না বললেই চলে। এখন জনগণের প্রয়োজন মেটানোর প্রায় সব শিল্প-সামগ্রীই বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্টস পণ্যসহ অনেক শিল্পসামগ্রী, ঔষধ, টিন, কাঁচ, সিরামিক, ছোট জাহাজ, চামড়াজাত দ্রব্য, প্লাস্টিক ইত্যাদি বহির্বিশ্বে রপ্তানি হচ্ছে। দারিদ্র্য বিমোচনে সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি। ২০০২ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ। তা ২০১৬ সালে নেমে এসেছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে। ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২২ সালে ১৭ শতাংশ নেমে এসেছে। এরপরও সংখ্যার হিসেবে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন লোক এখনো চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছে। ভাবছি, কয়েক হাজার মাইল দূরে চলমান যুদ্ধের প্রভাবে বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে অন্যান্য জিনিসের মূল্য। দাম যাই হোক চাহিদা মোতাবেক মাল আছে বলে হয়তো দেশীয় গণমাধ্যমগুলো বর্তমান পরিস্থিতিকে দূর্ভিক্ষ বলে প্রচার করতে পারছে না। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অবস্থা মোটেও ভালো না। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, আফগানিস্থান, মিয়ানমার, নেপালসহ এশিয়ার বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণ প্রচন্ড অভাবের মোকাবেলা করছে। যেকোনো মূহুর্তে অভাব টর্নেডোর রূপ ধারণ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আঘাত হানতে পারে। বাংলাদেশে এখন খুব দরকার স্থায়ী, দীর্ঘমেয়াদী সরকার এবং স্বল্পমেয়াদী-দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনা। অস্থির রাজনীতি, দখলী রাজনীতি, হিংসাতœক রাজনীতি দেশ-জাতিকে অনেক দূর পিছিয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পার করলো বাংলাদেশ। স্বাধীন জাতি হিসেবে দীর্ঘ সময় পেলেও যেকোনো অভাবী ঝড়ের মোকাবেলায় দেশটি কতটুকু শক্তি সঞ্চার করতে পেরেছে এমন প্রশ্নের উত্তর অজানাই রয়ে গেছে। এ অঞ্চলের মানুষ রাষ্ট্রীয় শাসন শোষণের যাতাকলে বারবার পিষ্ট হয়েছে। সাধারণ জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন সংগ্রাম যাই হোক ভাগ্যে হাড়হাড্ডি ছাড়া কিছুই জোটেনি। তবে রাজনীতির সঙ্গার পরিবর্তন হয়েছে। রাজনীতির বেশ ভুষায় মোটাতাজা, ফিটফাট হয়েছে। চলনে বলনে স্মার্ট হয়েছে। সুবিধাভোগী কিছুলোক অপরাজনীতির চর্চায়, অনৈতিক কর্মে সুনিপুণভাবে প্রথম স্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছে।

বর্তমানে আমাদের রাজনীতি কোথায় অবস্থান করছে তা দেখার জন্য ১৯৭৪ সালের ১৫ জানুয়ারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে রাখা বঙ্গবন্ধুর উদ্বোধনী ভাষণটি তুলে ধরার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছি। দেখে আসি, জাতির জনক শেষ সেই কাউন্সিলে নেতা কর্মীদের কি আদেশ, উপদেশ, ভর্ৎসনা করেছিলেন। “যদি আজ জনগণ তোমাদের ভালো না বাসে, জনগণ যদি আজ তোমাদের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে সে জন্য বাংলার জনগণ দায়ী হবে না। দায়ী হবে তোমরা। দেশ শাসন করতে হলে নিঃস্বার্থ কর্মীর প্রয়োজন। হাওয়া কথা চলে না, আত্মসমালোচনা করো। আত্মসমালোচনা করতে না পারলে নিজেকে চিনতে পারবে না। আত্মশুদ্ধি করো, দেশের মঙ্গল করতে পারবা। কোনো লোভের বশবর্তী হয়ে, কোনো শয়তানের কাছে মাথা নত করি নাই। ফাঁসির কাষ্ঠে বসেও বাংলার মানুষের সঙ্গে বেইমানি করি নাই। বিশ্বাস করি তোমরা আমার কথা শুনবা। তোমরা আত্মসমালোচনা করো, আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধ করো। দুই-চারটা, পাঁচটা লোক অন্যায় করে। তবে যার জন্য এতো বড় প্রতিষ্ঠান, যে প্রতিষ্ঠান ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, যে প্রতিষ্ঠান স্বাধীনতা এনেছে, যে প্রতিষ্ঠানের লাখ লাখ লোক জীবন দিয়েছে, তার বদনাম হতে পারে না। আজ বাংলার নিভৃত কোনে আমার এককর্মী পড়ে আছে, জামা নাই, কাপড় নাই। তারা আমার কাছে আসে না। আপনাদের অনেকে এখানে আছেন, আমি যদি চর অঞ্চলে ঘুরতে যাই, আমার গ্রামের একটা কর্মীকে দেখি, এদের সাথে আমার রক্তের সম্বন্ধ। আজ আমি দেখি তার পরনে ছেঁড়া লুঙ্গি। আজও দেখি সেই ছেঁড়া পায়জামা, ছেঁড়া শার্ট, পায়ে জুতা নাই। বাংলাদেশে আমার এ ধরনের লাখ লাখ কর্মী পড়ে আছে। কিন্তু কিছুলোক যখন মধু মক্ষèীর গন্ধ পায়, তখন তারা আওয়ামী লীগে এসে ভীড় জমায়। আওয়ামী লীগের নামে লুটতরাজ করে। পারমিট নিয়ে ব্যবসা করার চেষ্টা করে” (ভাষণের আংশিক)। আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছিল দল থেকে তাদের উৎখাত করে দিতে হবে। আওয়ামী লীগে থাকার অধিকার তাদের নেই। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বাঙালির প্রাণের স্পন্দন শেখ সাহেব প্রতিনিয়ত মৃত্যু মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করেছেন স্বাধীনতা অর্জনের সর্বস্ব পণ নিয়ে। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় আসে। এরপর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে তিনি বাঁধ ভাঙা আবেগে অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন, “আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম, বলেছিলাম আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান একবার মরে দুইবার মরে না। আমি বলেছিলাম আমার মৃত্যু আসে যদি হাসতে হাসতে যাবো, আমার বাঙালি জাতকে অপমান করে যাবো না, তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইবো না এবং যাবার সময় বলে যাবো জয় বাংলা, বাংলা স্বাধীন, বাঙালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান। আমার শেষ অনুরোধ আমার দেহ বাংলার মাটিতে, আমার বাঙালির কাছে পৌছাইয়ে দিবা”।

আদর্শিক রাজনীতি একদিন জননীতিতে রূপান্তরিত হয়। সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালোবাসায় কানায় কনায় ভরে উঠে রাজনীতিক, সমাজসেবীর জীবন। আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাই, রাজনীতিবিদ হিসেবে, বায়ান্নর বর্ণমালার সংগ্রাম, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আটান্নর সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা-আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সবটা জুড়ে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ, নীতি ও নেতৃত্বের কঠিন পরীক্ষা, ত্যাগ ও সাধনা। একটু চিন্তা করলে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধুর আমলের আওয়ামী লীগের মধ্যে কোন পরিবর্তন নেই, কেবল সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে কিছু নেতাকর্মী দলের আদর্শ নিয়ে জনকল্যানের কথা চিন্তা করছে সত্য, বাকি সিংহভাগ চেয়ারম্যান, এমপি, মন্ত্রী ও তাদের চৌদ্দগোষ্ঠী, দলীয় পদে থাকা সুবিধাভোগীচক্র, আমলাচক্র শেখ হাসিনার আদেশ উপেক্ষা করে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অনৈতিক সুবিধার সাথে জড়িয়ে পড়েছে। বাদ পড়ছে না অঙ্গ সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব। ঘটনা, পরিস্থিতি অজানা নয় টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার। তাঁর বেশকিছু উক্তি বিশ্লেষণ করলে এমনটাই খুঁজে পাওয়া যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে প্রায় ৯০ ভাগ মানুষই মুসলামান। অথচ এখানে ধর্মের নামে এক শ্রেণির মানুষ অধর্ম কায়েম করেছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষকে দাঁড় করিয়েছে মানুষের শত্রুরূপে। আসলে চরিত্রহীন লোকের মুখে ধর্মের বুলি, আদর্শ প্রতিষ্ঠা পাবে না। একটু পিছনে তাকালে আমরা দেখতে পাবো ধর্মীয় কারণে ইউরোপে সপ্তদশ শতাব্দীতে প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক দুটি খ্রিষ্টান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। যুগে যুগে ধর্মীয় সংঘাতে প্রাণ দিয়েছে অসংখ্য মানুষ। এই তো কিছু দিন আগে নিউজিল্যান্ডের মসজিদে কুখ্যাত খ্রিষ্টান যুবকের নির্বিচার গুলিতে প্রাণ হারান ৫০ এর বেশি নিরপরাধ মানুষ। ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকায় বর্ণ বিদ্বেষে প্রাণ হারায় অগণিত মানুষ। আমেরিকায় সমঅধিকার দাবির স্বার্থে প্রাণ দিয়েছেন নিগ্রো নেতা মার্কিন লুথার কিং। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রকৃত ধর্মীয়, মানবিক মূল্যবোধে গড়ে উঠা কোনো ব্যক্তি কখনো অপর মানুষের ক্ষতি করতে বলে না। সত্যটা হলো, মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। ৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের নির্মম কালো অধ্যায়ের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সকলেই মুসলমান, আওয়ামী লীগেরই এমপি, মন্ত্রী ও নেতা। ইসলাম ধর্মের কোথাও কি আছে মানুষ হত্যা করা যাবে ? ইসলাম ধর্মে কি বলেছে মানুষের রক্ত নিয়ে উল্লাস করতে হবে ? অমানুষগুলো অপরাজনীতিতে বেশ মোটা তাজা হয়ে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় এদেশের গর্বিত সেনাবাহিনীর আদর্শচ্যুত কতিপয় সদস্যকে সাথে নিয়ে বঙ্গপিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। শুধু তাই নয়, সেইদিন খুনিদের হাত থেকে নারী শিশুরাও রক্ষা পায়নি। ক্রীত দাসের মুক্তির জন্য জন ব্রাউন বিশ্ববাসীর কাছে অমর হয়ে থাকলেও আমরা তা করতে পারিনি। আজ তাই বলতেই হয় অকৃতজ্ঞ আমরা, হায়-রে অকৃতজ্ঞ বাঙালি! ওরা ব্রাউনকে ভোলেনি। দেশের দুর্বল আইনের শাসন, বারবার বেগানার উকি ঝুকি আক্রমণে অপরাজনীতির কবলে পড়ে দেশ জাতি সর্বহারা, উলঙ্গ হয়েছে। তামাম দুনিয়ার অন্যান্য জাতির কাছে দেশ, জাতিকে খাটো করেছে। রাজনীতির মাঠে লোভী বেইমান শ্রেণির অনৈতিক, মানবিক মূল্যবোধহীন, আদর্শচ্যুত কর্মকান্ড একটুও থামেনি, চলছে তো চলছে। দেশীয় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম শ্রেণির অনেক নেতাই জানেনা দলের আদর্শ, উদ্দেশ্য, রাষ্ট্র ও রাজনীতি কি ? মধুবনে, জানা-বোঝা-শেখার সময় কোথায় ? যে ভূখন্ডের নাগরিক তাদের যোগ্যতা ও শিক্ষা, জ্ঞানের ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী স্ব-স্ব কর্তব্য, নিষ্ঠা, বিশ্বস্ততার সাথে পালন করে, পরস্পরের সহযোগীতার মনোভাব নিয়ে একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডে সরকার, সংবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সহাবস্থান করে, একে অপরের অধিকারে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ করে না সেটাই রাষ্ট্র, শান্তিপূর্ণ ভূখন্ড। রাষ্ট্র পরিচালনায় নীতি নির্ধারকগণ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে নীতি বা আদর্শ গ্রহণ করে তাই রাজনীতি কিংবা জননীতি। আমাদের জানা প্রয়োজন শুধু রাজনীতিক নয়, একজন আদর্শ মানুষ গড়ে উঠার নেপথ্যে যে কয়টি গুণাগুণ রয়েছে, নৈতিকতা ও সামাজিক-মানবিক মূল্যবোধ এর মধ্যে প্রধান। সমাজকে সুন্দর, সম্প্রীতি সম্পন্ন করে গড়ে তুলতে যে চেতনাবোধ কাজ করে তাই সামাজিক মূল্যবোধ। নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধ, গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ দেশ, জাতি এবং পরিবারের অহংকার। মানবিক আদর্শের একটি বড় অংশ দখল করে আছে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। নৈতিকতা হলো পরিপূর্ণ একজন মানুষের মানদন্ড। সামাজিক মূল্যবোধও নৈতিকতার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানবতাবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন, শালীনতাবোধই নৈতিকতা। অপরদিকে সামাজিক মূল্যবোধকে সঙ্গায়িত করলে দাঁড়ায়, কোনো সমাজকে সুন্দর, সম্প্রীতি সম্পন্ন করে গড়ে তুলতে যে চেতনাবোধ কাজ করে তাই সামাজিক মূল্যবোধ। যেকোনো মানব জাতির ধর্ম বা সংস্কৃতি থেকে নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধের মতো গুণাবলী অর্জন করতে হয়। বস্তুত এই দুটি গুণবলি না থাকার কারণে মানুষ হয়ে ওঠে উচ্ছৃঙ্খল। অসামাজিক কর্মকান্ড বেপরোয়া গতিতে বৃদ্ধি পায়। সমাজ থেকে শান্তি হারিয়ে যায়, সৃষ্টি হয় অরাজকতা। বর্তমানে নীতি-নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধের অভাবে সমাজ, রাষ্ট্রে তৈরি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা, জন্ম নিচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়। দুর্নীতি হলো নীতি-নৈতিকতার অভাবজনিত সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বাস্তবচিত্র। নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষের অভাবে সমাজের প্রতিটা স্তরেই দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। যার প্রভাব পড়ছে রাষ্ট্রীয়ক্ষেত্রে, শিক্ষাক্ষেত্রে, চিকিৎসাক্ষেত্রে, চাকরিক্ষেত্রে, খাদ্যে। সব কিছুতেই ভেজার অনিয়ম দুর্নীতি। ২০২২ সালের জরীপ অনুসারে ১৮০টি দেশের তালিকায় দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৭তম। তবে আজ দুর্নীতির আলোচনায় যাব না। কারণ দুর্নীতি আমাদের নিত্য সঙ্গী। বিলা চোর একবার ধরা পড়লে জুতা পিটা আর কান ধরে ওঠ-বস করিয়ে মানবিক কারণে ছেড়ে দেওয়া হতো। ফিরতি রাতে আবারও ধরা পড়লে চরম গণ ধোলাই। অতঃপর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরলে সাক্ষাত। বিলাকে কষ্ট নিয়ে বলতে শোনা গেলো, “বাপু চুরিধুরি আর করা যাবেনা, কপালে টানছে না”। তাই বিলা চরিত্রের দুর্নীতিবাজ অসৎ লোক নিয়ে সময় নষ্ট করার কোনো প্রয়োজন নেই। কবি ও সাংবাদিক কালের কন্ঠ প্রতিনিধি, প্রেসক্লাব চৌগাছা’র বারবার নির্বাচিত সেক্রেটারী স্নেহাশীষ শাহানুর আলম উজ্জ্বলের কথা ফেলতে পারলাম না, লেখতে বসলাম। স্থান সময় স্বল্পতার কারণে লেখার মধ্যে অনেক তথ্যঘাটতি রয়েছে, এই জন্য ক্ষমা প্রার্থী।

সর্বশেষে বলি, যা আমাদের নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তা কি পরিহার করতে পারি না ? আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে চরিত্র হলো নৈতিকতা ও মূল্যবোধের একটি অংশ। চারিত্রিক সমস্যার কারণে সৃষ্টি হচ্ছে হাজারো সমস্যা। হত্যা, খুন, গুম, পারিবারিক অশান্তি, পরকীয়া, ধর্ষণের মতো বিশৃঙ্খলা। সর্বগ্রাসী রাজনৈতিক, সামাজিক অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি। সেই সঙ্গে আমাদের সংস্কুতির চেতনা অনুশাসনের অনুশীলন, পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করাসহ সর্বক্ষেত্রে অশ্লীলতাকে শুধু বর্জনই নয়, প্রতিরোধ করা আজ আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব-কর্তব্য ও সময়ের দাবি বটে।

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সভাপতি- প্রেসক্লাব, চৌগাছা, যশোর।

Email- amc7dhaka@gmail.com

Facebook- alamgir matin chowdhury